বৃহস্পতিবার, অক্টোবর 23, 2025
32 C
Dhaka

শিশুস্বাস্থ্য সুরক্ষায় স্কুলে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের কঠোর বাস্তবায়ন দরকার

প্রায়ই দেখা যায়, স্কুল প্রাঙ্গণে ধূমপানের ধোঁয়া নতুন প্রজন্মকে গ্রাস করছে। কিশোর-কিশোরীরা নীরবে তামাক আসক্তির দিকে ধাবিত হচ্ছে, যা তাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি। গ্লোবাল ইয়ুথ টোব্যাকো সার্ভে (২০১৩) অনুযায়ী, দেশের স্কুলগামী কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে তামাক ব্যবহার একটি উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। ১৩ থেকে ১৫ বছর বয়সী ছেলেদের ৯.২ শতাংশ এবং মেয়েদের ২.৮ শতাংশ ধূমপান করে, আর একই বয়সের ছেলেদের ৬.২ শতাংশ ও মেয়েদের ২.৯ শতাংশ ধোঁয়াবিহীন তামাক ব্যবহার করে। এছাড়া একই বয়সী শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৫৯ শতাংশ পাবলিক স্থানে এবং ৩১.১ শতাংশ বাড়িতে পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হন।

অন্য একটি সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকার আশপাশের স্কুলে পড়া শিশুদের মুখের লালায় উচ্চমাত্রায় নিকোটিন পাওয়া গেছে (কামরান এট এল, ২০২৪)—যা জনস্বাস্থ্যের জন্য উদ্বেগজনক। এখন সময় এসেছে শিশু ও কিশোরদের মধ্যে তামাক ব্যবহার রোধে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার।

বিশ্বব্যাপী বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে কিশোরদের মধ্যে তামাক ব্যবহার বেড়েই চলেছে। বিশেষ করে ই-সিগারেট ও অন্যান্য নতুন ধরনের তামাক পণ্যের আগ্রাসন এই সংকটকে আরও জটিল করেছে। আকর্ষণীয় গন্ধ, রং ও ডিজাইনের মাধ্যমে এসব পণ্য কিশোরদের সহজেই আকৃষ্ট করছে। এগুলো কেবল সাময়িক আনন্দ দেয় না, বরং দীর্ঘমেয়াদে শারীরিক সুস্থতা, মনোযোগ ও শিক্ষাজীবনে গভীর প্রভাব ফেলে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) সাম্প্রতিক (অক্টোবর ২০২৫) প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বজুড়ে অন্তত ১৩-১৫ বছর বয়সী ১ কোটি ৫০ লাখ কিশোর বর্তমানে ই-সিগারেট ব্যবহার করছে। উদ্বেগের বিষয় হলো, কিশোররা প্রাপ্তবয়স্কদের তুলনায় গড়ে ৯ গুণ বেশি ই-সিগারেট ব্যবহার করছে। এটি মোটেও অপ্রত্যাশিত নয়, কারণ তামাক কোম্পানিগুলো শিশু ও তরুণদের লক্ষ্য করে ডিজিটাল মাধ্যমে আগ্রাসী বিপণন চালাচ্ছে।

স্কুলে তামাক ব্যবহারের অন্যতম প্রধান কারণ হলো সহজলভ্যতা। গ্লোবাল ইয়ুথ টোব্যাকো সার্ভে ২০১৩ অনুযায়ী, ধূমপায়ী কিশোরদের প্রায় অর্ধেকই দোকান থেকে সহজেই তামাক পণ্য কিনতে পারে, যদিও তাদের কাছে বিক্রয় আইনত নিষিদ্ধ। এছাড়াও প্রায় ৭০ শতাংশ কিশোর কোনো না কোনোভাবে তামাকের বিজ্ঞাপন বা প্রচারণার মুখোমুখি হয়, যা তাদের আগ্রহ বাড়িয়ে দেয়। তবে ইতিবাচক দিক হলো, ধূমপায়ী কিশোরদের মধ্যে প্রায় ৭৩ শতাংশ ধূমপান ছাড়তে চায়, কিন্তু তারা পর্যাপ্ত সহায়তা পায় না। এসব তথ্য ইঙ্গিত করে যে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও আশপাশের এলাকাকে তামাকমুক্ত না করলে নতুন প্রজন্মকে আসক্তি থেকে রক্ষা করা সম্ভব নয়।

তামাক ব্যবহারের প্রভাব বহুমাত্রিক। স্বাস্থ্যগতভাবে এটি ফুসফুস ও শ্বাসনালীর রোগ, হৃদরোগ এবং বিভিন্ন ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়। পাশাপাশি, শিক্ষার ক্ষেত্রেও এর প্রভাব গভীর— ঘুমের মান নষ্ট হয়, মনোযোগ কমে ও শিক্ষার অগ্রগতি ব্যাহত হয়। দীর্ঘমেয়াদে এ সমস্যা সমাজ ও অর্থনীতিতেও আঘাত হানে। শিশুদের অসুস্থতা ও চিকিৎসা ব্যয় বাড়ায়, ভবিষ্যতের উৎপাদনশীলতা কমে যায়, যা জাতীয় অর্থনীতির জন্যও ক্ষতিকর।

এই বাস্তবতায় এখনই প্রয়োজন কার্যকর নীতি ও কঠোর প্রয়োগ। প্রথমত, স্কুল প্রাঙ্গণ ও তার আশপাশে ১০০ গজের মধ্যে তামাক বিক্রি ও ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করতে হবে। দ্বিতীয়ত, কিশোরদের জন্য নিয়মিত সচেতনতা ও শিক্ষামূলক কর্মসূচি চালানো জরুরি— যেমন অ্যাসেম্বলিতে তামাকের ক্ষতি নিয়ে আলোচনা, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের জন্য প্রশিক্ষণ এবং ধূমপানবিরোধী ক্লাব গঠন। তৃতীয়ত, শিক্ষক ও কর্মচারীদের প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরে ধূমপান না করা, যাতে তারা শিক্ষার্থীদের কাছে ইতিবাচক রোল মডেল হন। চতুর্থত, পরিবার, অভিভাবক ও স্থানীয় সম্প্রদায়কে যুক্ত করতে হবে— কারণ শিশুদের আচরণে পারিবারিক প্রভাব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

এছাড়া, সরকারকে তামাক বিক্রি, বিজ্ঞাপন ও প্রোমোশন নিয়ন্ত্রণে আরও কঠোর হতে হবে এবং কিশোরদের জন্য ন্যূনতম ক্রয়যোগ্য বয়স কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন বাস্তবায়নে প্রশাসন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সিভিল সোসাইটির সমন্বিত উদ্যোগ ছাড়া এই সংকট মোকাবিলা সম্ভব নয়।

তামাকমুক্ত স্কুল কেবল একটি নীতি নয়— এটি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নিরাপত্তার অঙ্গীকার। আজই পদক্ষেপ নিলে আমরা শুধু শিশুদের আসক্তি থেকে রক্ষা করব না, বরং একটি স্বাস্থ্যবান, সচেতন ও নিকোটিনমুক্ত প্রজন্ম গড়ে তুলতে পারব।

Hot this week

রাকসু নির্বাচনের গেজেট প্রকাশ

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (রাকসু), হল সংসদ ও...

নন-ক্যাডার পদে নিয়োগবিধি নিয়ে নতুন বার্তা সারজিসের

নন-ক্যাডার পদে নিয়োগ বিশেষ সংশোধন বিধিমালাসংশোধন নিয়ে নতুন বার্তা...

১১৯ বছরের পুরোনো রেকর্ড ভাঙলেন রাবাদা

রাওয়ালপিন্ডি টেস্টে ঘটল এক বিরল দৃশ্য—স্পিডস্টার কাগিসো রাবাদা শুধু...

শুধু আয়ে নয় সুযোগেও বৈষম্য রয়ে গেছে: ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ। অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ উপদেষ্টা। তিনি ২০২৪ সালের...

আমাদের নিরপেক্ষতা নিয়ে নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন : জামায়াতকে প্রধান উপদেষ্টা

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন,...

Topics

রাকসু নির্বাচনের গেজেট প্রকাশ

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (রাকসু), হল সংসদ ও...

নন-ক্যাডার পদে নিয়োগবিধি নিয়ে নতুন বার্তা সারজিসের

নন-ক্যাডার পদে নিয়োগ বিশেষ সংশোধন বিধিমালাসংশোধন নিয়ে নতুন বার্তা...

১১৯ বছরের পুরোনো রেকর্ড ভাঙলেন রাবাদা

রাওয়ালপিন্ডি টেস্টে ঘটল এক বিরল দৃশ্য—স্পিডস্টার কাগিসো রাবাদা শুধু...

শুধু আয়ে নয় সুযোগেও বৈষম্য রয়ে গেছে: ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ। অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ উপদেষ্টা। তিনি ২০২৪ সালের...

আমাদের নিরপেক্ষতা নিয়ে নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন : জামায়াতকে প্রধান উপদেষ্টা

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন,...

ফোনের চার্জিং পোর্টে এই ৫টি জিনিস কখনোই লাগাবেন না

স্মার্টফোনের ইউএসবি পোর্ট শুধু চার্জ দেওয়ার জন্য নয়, বরং...

অন্তরে আল্লাহ-রাসুল সম্পর্কে বাজে চিন্তা এলে যে ৫ কাজ করবেন

মানুষের মনে বিভিন্ন মন্দ ভাবনা আসে। কখনো এমনসব অবাঞ্ছিত...

১৩ খাতে বিদেশি কর্মী নিয়োগে সুখবর দিল মালয়েশিয়া

নিজেদের গুরুত্বপূর্ণ ১৩টি খাতে শ্রমঘাটতি পূরণের লক্ষ্যে বিদেশি কর্মী...
spot_img

Related Articles

Popular Categories

spot_imgspot_img